প্রকাশিত হয়েছেঃ নভেম্বর ৫, ২০২৪ সময়ঃ ১০:৩৬ অপরাহ্ণ
আসাদুজ্জামান ভালুকা (ময়মনসিংহ)।।
ময়মনসিংহের ভালুকার দু’টি রেঞ্জের আওতায় প্রায় শতাধিক অবৈধ করাতকল গিলে খাচ্ছে জাতীয় উদ্যানসহ সংরক্ষিতি বনের গাছ। উদ্যানের প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে উপজেলার বাটাজোর বাজারে ৮/১০ টিসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা এসব অবৈধ করাতকলে অবাধে চেরাই হচ্ছে বিশাল বিশাল শাল-গজারি ও আকাশমনি গাছ। একটি সঙ্ঘবদ্ধ গাছ পাঁচারকারীদল স্থানীয় বনবিভাগকে ম্যানেজ করে রাতের আধাঁরে অব্যাহতভাবে সরকারি বনের গাছ কেটে নিয়ে দিনদুপুরে এসব করাতকলে চেরাই করছে। আর বনবিভাগকে মিল প্রতি দুই হাজার টাকা মাসোহারা দিয়ে করাতকলগুলো পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে হুমকীর মুখে পরেছে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভালুকার কাচিনা ইউনিয়নের কাচিনা, বাটাজোর বাজার, মল্লিকবাড়ি, মাস্টারবাড়ি, কাশরগড়, মহাসড়ক সংলগ্ন মল্লিকবাড়ি মোড় ও মল্লিকবাড়ি বাজার, উথুরা রেঞ্জ অফিস সংলগ্ন, উথুরা বাজার, চামিয়াদী বাজার, কৈয়াদী বাজার, ভরাডোবা বাসস্ট্যান্ড এলাকা, আঙ্গারগাড়া, ডাকাতিয়া চৌরাস্তা বাজার, পনাশাইল বাজার, বিরুনীয়া বাজার ও চান্দাব বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠা শতাধিক লাইসেন্সবিহীন করাতকলে দিনরাত চলে শাল-গজারি ও আকাশমনি কাঠ চেরাই। বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবাধে এসব গাছ কাটা হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
জানা গেছে, বৃক্ষসম্পদ সংরক্ষণ ও পর্যটন সুবিধা উন্নয়নের জন্য সরকার বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও সংশোধন) আইন ১৯৭৪-এর ২৩ (৩) ধারার আওতায় ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর এক আদেশবলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের পালগাঁও এলাকায় ৮৫০ একর ভূমির সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে কাদিগড় জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে রয়েছে পুরনো শাল-গজারি গাছের অপরূপ সবুজের সমারোহ। জাতীয় উদ্যান হিসেবে ওই এলাকাটি চিহ্নিত হওয়ার পর তা সংরক্ষণে সরকারিভাবে কাজ শুরু হয়। কিন্তু জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে একটি চক্র উদ্যানের গাছ কাটা শুরু করে। চক্রটি রাতে উদ্যান এলাকা থেকে গজারি গাছ কেটে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে পার্শ্ববর্তী বাটাজোর বাজার ও আশপাশের বিভিন্ন করাতকল মালিকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
বনআইনে বন এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও কাদিগড় বনাঞ্চল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে কাচিনা বাজার ও আড়াই কিলোমিটার দূরে বাটাজোর বাজার এলাকায় ২০টি লাইসেন্সবিহীন করাতকল দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব করাতকলে উদ্যানের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের কাঠ চেরাই করা হয়। কাদিগড় বনবিট অফিস থেকে মাত্র এক-দেড় কিলোমিটার দূরে বাটাজোর বাজারে আতিক মন্ডল, পলাশ তালুকদার, সেলিম তালুকদার, ইমরুল তালুকাদার, জাহাঙ্গীর মেম্বার, নয়ন মিয়া ও পাপনের মালিকানাধীন অবৈধ করাতকল ছাড়াও আরো সাত-আটটি করাতকলে প্রকাশ্যেই চেরাই করা হচ্ছে বনের গাছ। শুধু কাচিনা আর বাটাজোরই নয়, জাতীয় উদ্যানের মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে তামাট বাজারে শাহীন মেম্বারের মালিকানাধীন করাতকলসহ তিনটি করাতকলে রাতদিন বনের গাছ চেরাই করা হয়। ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য ও ধ্বংস হচ্ছে জাতীয় সম্পদ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কিছুদিন আগেও উদ্যান এলাকায় মেছোবাঘ, লজ্জাবতী বানরসহ কয়েক প্রজাতির প্রাণী উন্মুক্ত করা হলেও বন উজাড় হওয়ায় এদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উদাসীনতার সুযোগ নিচ্ছে অবৈধ করাতকল মলিক ও কাঠ পাচারকারী সংঘবদ্ধ চক্র।
এদিকে ভালুকা রেঞ্জের হবিরবাড়ি বিটের অদূরে খন্দকারপাড়া মোড়ে অবৈধ করাতকল বসিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ১১ গড় নামে পরিচিত বিশাল বন এলাকাসহ আশপাশের বিশাল বিশাল গজারী গাছ রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে তার নিজস্ব করাতকলে চেরাই করে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া মাস্টারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রহিম নামে এক ব্যক্তি মহাসড়কের পশ্চিম পাশে অবৈধ করাতকল বসিয়ে দিনরাত বনের কাঠ চেরাই করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক করাতকল মালিক জানান, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এমনকি প্রতি মাসে প্রতিটি করাতকল পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট হারে সেলামী দিয়ে লাইসেন্স ছাড়াই বছরের পর বছর উদ্যোনের গাছ কেটে চেরাই করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, এলাকার প্রত্যেকটি স’ মিল মালিকের নিজস্ব ফার্নিচারের দোকান রয়েছে। তাই এসব চোরাই কাঠ সহজেই আশপাশ এলাকায় বিক্রিসহ তাদের ফার্নিচারের দোকানে ব্যবহার করতে পারেন। ভালুকা রেঞ্জর অফিসের সামনে একটি ফার্ণিচারের দোকানে বনবিভাগের অসাধূ ব্যক্তিরা ফার্ণিচার তৈরী করে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলার বাটাজোর বাজারে অবস্থিত অবৈধ দু’টি করাতকলের মালিক নয়ন মিয়া জানান, তারা প্রতি মাসে সব মিল থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা কালেকশন করে স্থানীয় বনবিট অফিসকে মাসোহারা দিয়েই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
এ ব্যাপারে কাদিগড় বিট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন খানের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্য সচিব কামরুল হাসান পাঠান কামাল জানান, ভালুকায় একদিকে ইটিভি বন্ধ রেখে মিল কারখানাগুলো অব্যাহতভাবে বর্জ্য ফেলে পরিবেশের ক্ষতি ক্ষতি করছে। আর অপরদিকে অবৈধ শতাধিক করাতকল জাতীয় উদ্যানসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছপালা কেটে সাবার করে চলেছে।
ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী নূর খান বলেন, ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা রোধে বনবিভাগের সাথে কথা বলে অচিরেই অভিযানের মাধ্যমে অবৈধ করাতকলগুলো উচ্ছেদ করা হবে।