প্রকাশিত হয়েছেঃ অক্টোবর ১৫, ২০২৪ সময়ঃ ৩:০৯ অপরাহ্ণ

Spread the love

নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর থেকে।।
তিন স্তরের সিন্ডিকেট দেশের বিদ্যুৎ বিভাগকে গিলে ফেলেছে। হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) টঙ্গী ৮০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, টঙ্গী কেন্দ্রীয় ভান্ডার, কেন্দ্রীয় সরঞ্জাম মেরামত কারখানা, আঞ্চলিক সরঞ্জাম মেরামত কারখানা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ টঙ্গী-গাজীপুরসহ দেশের সর্বত্রই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে দুর্নীতি, লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যে লিপ্ত। বিএনপি আমলে স্থাপিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রেখে গাজীপুরে একাধিক প্রাইভেট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে ভর্তুকি মূল্যে শত শত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসররা নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে পিডিবিকে পরনির্ভরশীল করে রাখতে এখনো বিদ্যুৎ ভবনে বসে কলকাটি নাড়ছে।
পিডিবি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় খুচরায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। খুচরায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রায় ৩০০ শতাংশ বাড়ানো হলেও এই সময়ে বিদ্যুত খাতের লোকসান ঠেকেছে ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে। বিপরীতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ খাতে তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের বৈধতা দিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী দ্রæত সম্প্রসারণ আইন ২০১০ (সংশোধিত) এর আওতায় বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত করণ, অধিকাংশ ক্রয় চুক্তিতে ডলারে অর্থ পরিশোধ, বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ ক্রয়, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাজার মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে মালামাল ক্রয় পিডিবির লোকসানের অন্যতম কারণ। এছাড়া ঘুষ না দেওয়ায় অর্থ পরিদপ্তর কর্তৃক ঠিকাদারদের বিল আটকে রাখার ফলে পরবর্তীতে ডলারের বর্ধিতমূল্যে কোটি কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করে লোকসানের বোঝা বাড়ানো হয়েছে।
বিপুল অঙ্কের এই লোকসানের জন্য দায়ী ফ্যাসিবাদের তিন স্তরের সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে প্রথম স্তর বা উচ্চ পর্যায়ের সিন্ডিকেটে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার, জ¦ালানি উপদেষ্টা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সচিব, এস আলম গ্রæপ, সামিট গ্রæপ, বেক্সিমকো গ্রæপ, ইউনাইটেড গ্রæপ, হোসাপ এনার্জি প্যাকসহ উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী মহল। দ্বিতীয় স্তর বা মধ্যম পর্যায়ের সিন্ডিকেটে রয়েছে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ, পিডিবি চেয়ারম্যান, মেম্বার, বিভিন্ন টিইসি (দরপত্র মূল্যায়ন) কমিটির সদস্য ও নিয়ন্ত্রক (হিসাব ও অর্থ) এবং তাদের আর্শিবাদপুষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, যথা- ওকুলান ট্যাক বিডি, ওয়েবার লিমিটেড, ভারচ্যু লিমিটেড, বিএমআইটি লিমিটেড, জেএন্ডসি এনরিচ লিমিটেড, আইডিয়াল লিমিটেড ও কনফিডেন্স লিমিটেড ইত্যাদি। তৃতীয় স্তর বা তৃতীয় পর্যায়ের সিন্ডিকেটে রয়েছে সিএসও টু চেয়ারম্যান, পরিচালক (অর্থ), উপ-সচিব ও পরিচালক (অডিট) উপ-পরিচালক (ফান্ড)। তাদের মধ্যে সিএসও টু চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান একই পদে ৪ বছর ৯ মাস, পরিচালক অর্থ হাবিব উল্লাহ একই দপ্তরে ৪ বছর, উপ-সচিব আব্দুল হালিম একই পদে ৯ বছর ১ মাস, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পরিচালক (অডিট) রুহুল কবীর অর্থ পরিদপ্তরে ছিলেন টানা ৯ বছর, সহকারী পরিচালক পদ হতে পদেœœতি পেলেও নূরুস ছাফা উপ-পরিচালক (ফান্ড) পদে একই দপ্তরে ৮ বছর ও উপ-পরিচালক (ফান্ড) মেহবুব মোরশেদ একই পদে ৭ বছর যাবত বহাল তবিয়তে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে বঙ্গবন্ধু কর্মকর্তা পরিষদের সভাপতি নাছরুল হক (নিয়ন্ত্রক, হিসাব ও অর্থ) ও সাধারণ সম্পাদক পরিচালক (অডিট) রুহুল কবিরের নেতৃত্বে নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের আরো একটি পরিষদ সিন্ডিকেট বাণিজ্যকে সরাসরি পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা দীর্ঘ দিন যাবত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের লোভনীয় অর্থপরিদপ্তরে কর্মরত থেকে ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যান।
লুটেরাদের ব্যাংকে পিডিবির ৩ হাজার ৮১৭ কোটি টাকার জামানত মারাত্মক ঝুঁকিতে ঃ
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পেনশন ফান্ড, জিপিএফ ফান্ড, ডেপ্রিসিয়েশন ফান্ড, গ্রাহক জামানতের অর্থ, ঠিকাদার জামানতের অর্থ, বীমা তহবিলের অর্থ ইত্যাদি বাবদ জমাকৃত অর্থ স্থায়ী জামানত হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা হয়। এই স্থায়ী জামানতের পরিমাণ সুদসহ ৪ হাজার ৪৪৮ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮১৭ দশমিক ২ কোটি টাকাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মালিকানাধীন দুর্বল ব্যাংক সমূহে জামানত রাখার ফলে এসব অর্থ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। ফ্যাসিবাদের সর্বপ্রথম লুটপাটের শিকার রাষ্ট্রায়ত্ব বেসিক ব্যাংকে রাখা হয় ১ হাজার ৬৬১ দশমিক ৬২ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫৩৯ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১৭১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকে ১৮১ দশমিক ৮২ কোটি টাকা, ইউসিবি ব্যাংকে ২৬২ দশমিক ৭ কোটি টাকা। নাছরুল হক (নিয়ন্ত্রক, হিসাব ও অর্থ), হাবিব উল্লাহ (পরিচালক,অর্থ) ও আব্দুল হালিম (উপ-সচিব) সিন্ডিকেট শতকরা দুই ভাগ কমিশন গ্রহণের মাধ্যমে দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে টাকা জমা করার ফলে এসব অর্থ অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন প্রয়োজনের সময় টাকা উত্তোলন করতে না পেরে কর্মচারীরা ক্রমেই আন্দোলনমুখী হচ্ছে।
ঠিকাদারদের বিল ছাড়ে শতকরা দুই ভাগ কমিশন সিন্ডিকেটের পকেটে ঃ সূত্র জানায়, অর্থ বাণিজ্যের আলোচিত সিন্ডিকেট ঠিকাদারী বিলের তহবিল স্থাপনের ক্ষেত্রে শত করা দুই ভাগ কমিশন নিয়ে থাকে। যে সকল প্রতিষ্ঠান কমিশন দিতে নারাজ তাদের বিল মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ডলারে পরিশোধযোগ্য তহবিল স্থাপন ইচ্ছাকৃত ধরে রাখার ফলে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি জনিত কারণে বিউবোকে কোটি কোটি টাকা লোকসান করতে হয়েছে। জিই ইন্টারন্যাশনাল এবং ভেলজি ইন্ডিয়া লিঃ এর বিল কোন কারণ ছাড়াই শুধু কমিশন না দেয়ার কারণে ৭ মাসের অধিক সময় আটকে রাখে। ইতিমধ্যে মার্কিন ডলারের মূল্য বেড়ে ১১১ টাকা টাকা থেকে ১২০ টাকায় উন্নিত হয়। ফলে বিউবোকে উল্লিখিত দু’টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ৫টি বিলে ১ কেটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৩ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে। এর দায়-দায়িত্ব নিরুপনের জন্য সম্প্রতি অডিট অফিস হতে পত্র দেওয়া সত্বেও সিন্ডিকেটের ভয়ে কেউ দায়িত্ব নিরুপনে সাহস পাচ্ছে না বলে সূত্র জানায়। মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত পিডিবির আর্থিক ক্ষমতা অর্পন বিধি লঙ্ঘন করে নিয়ন্ত্রক (হিসাব ও অর্থ) নাছরুল হক তার অধস্তন পদের ক্ষমতা অর্থাৎ পরিচালক (অর্থ) এর ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়ে নেন। ফলে পরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি যে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন নিয়ন্ত্রক হওয়ার পরও একাধারে উভয় পদের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। এর ফলে বোর্ডের তহবিল স্থাপনের সকল ক্ষমতাই তার একক হাতে। বিধি বহির্ভূত হলেও শুধু তৎকালীন সদস্য (অর্থ) সেক আকতার হোসেনের (বর্তমানে ওএসডি) নিকট থেকে এক নোটে অনুমোদন নিয়ে তিনি এই অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। এর ফলে তহবিল স্থাপনের জন্য আর্থিক ক্ষমতা অর্পন বিধি মোতাবেক যে কর্মকর্তাই অনুমোদন দিক না কেন নাছরুল হকের স্বাক্ষর ছাড়া ব্যাংক তহবিল স্থাপন করবে না। এতে ঠিকাদারেরা বাধ্য হয়েই তহবিলের জন্য তার কাছে ধর্ণা দিয়ে থাকেন। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা ছিল প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সচিব হাবিবুর রহমান, পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সদস্য (অর্থ) সেলিম আবেদ ও সেক আকতার হোসেন (ওএসডি)। ক্ষমতাচ্যুত হলেও তাদের উত্তরসূরীরাও আজোও বহাল তবিয়তে কমিশন বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ¦ালানী ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিগত সরকারের আমলে জ¦ালানী ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থ লোপাট হয়েছে। এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। এজন্য একজন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এদিকে এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আলোচিত নিয়ন্ত্রক (হিসাব ও অর্থ ) মোঃ নাছরুল হক বলেন, তিনি কোন রকম অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির সাথে জড়িত নন। হিসাব ও অর্থ শাখায় কোন সিন্ডিকেট নেই। তারা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক যথারীতি কাজ করেন।
#

প্রকাশক ও সম্পাদক

আসাদুজ্জামান (ফজলু)

হাউজ নং: ২০, ফ্ল্যাট নং: বি২, রোড নং: ০৭

সেকশন: ১২, উত্তরা, ঢাকা – ১২৩০

মোবাইল: ০১৭১৮-১৯২৬৮৫, ০১৭৬১-৫৮২৩৩৮

ইমেইল: contact@digontabarta.com